ফারায়েজ
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ চার বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টন করাকে ফারায়েজ বলে।
সুন্নি মুসলমানগণের সম্পত্তির উত্তরাধিকার, হানাফি আইন দ্বারা পরিচালিত বিধায় নিম্নে হানাফী আইনের উত্তরাধিকার উল্লেখ করা হলঃ
মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন, ঋণ পরিশোধ, উইল বা দান থাকলে সে সম্পত্তি পরিশোধের পর যে সম্পত্তি থাকবে, তা উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টিত হবে।
প্রাথমিক উত্তরাধিকারী ৬ জন, যারা কখনো সম্পত্তি প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয় না। যথা- (ক) পিতা (খ) মাতা (গ) স্বামী (ঘ) স্ত্রী (ঙ) পুত্র (চ) কন্যা। এই ৬ জন নিম্নলিখিত ভাবে সম্পত্তি পাবে-
পিতাঃ মৃত ব্যক্তির সম্পদের উপর তাঁর পিতা ৩ (তিন) প্রকারে সম্পদ পাবেন, যথা-
১। যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র, পুত্রের পুত্র কিংবা আরও নিচে পুত্রের পুত্রের পুত্র যত নিচেই হোক না কেন থাকে, তবে মৃত ব্যক্তির পিতা পাবেন সম্পদের ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬)।
২। যদি মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র কিংবা নিন্মগামী পুত্র না থাকে কেবল কন্যা থাকে, তবে ছয় ভাগের এক ভাগ ( ১/৬) পাবেন এবং কন্যাদের ও অন্যান্যদের দেয়ার পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকবে তাও পাবেন।
৩। যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকে, তবে বাদ বাকী অংশীদারদের দেয়ার পর সকল সম্পত্তি পিতা পাবেন।
মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান না থাকলে যদি পিতাও না থাকে, তবে তাঁর জীবিত ভাই সম্পত্তি পাবে, ভাই না থাকলে ভাইয়ের সন্তান পাবে।
মাতাঃ মৃত ব্যক্তির মাতা ৩ (তিন) ভাবে সম্পদ পাবেন, যথা-
১। যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নেরই হউক, থাকলে অথবা যদি পূর্ণ, বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন থাকে তবে মাতা ছয় ভাগের এক ভাগ ( ১/৬) পাবেন।
২। যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না থাকে এবং যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) পাবেন।
৩। যদি মৃত ব্যক্তির কোন সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি, যত নিম্নের হউক না থাকে অথবা কমপক্ষে দুইজন ভাইবোন না থাকে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী অংশ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ ( ১/৩) মাতা পাবেন।
স্বামীঃ স্বামী ২ (দুই) ভাবে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তি পাবে, যথা-
১। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি থাকে তবে স্বামী পাবে এক চতুর্থাংশ।
২। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান-সন্ততি না থাকে তবে স্বামী পাবে অর্ধেক সম্পত্তি।
স্ত্রীঃ স্ত্রী, মৃত স্বামীর সম্পত্তি ২ (দুই) ভাবে পাবে, যথা-
১। যদি মৃত ব্যক্তির এবং তাঁর স্ত্রীর সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে তবে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ (১/৮) পাবেন।
২।যদি মৃত ব্যক্তি এবং তাঁর স্ত্রীর সংসারে কোন সন্তান না থাকে তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ (১/৪) পাবেন।
পুত্রঃ পুত্র সকল ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির সম্পদ পেয়ে থাকে। এছাড়া, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি সকলের অংশ ভাগের পর অবশিষ্ট সকল অংশ পুত্র-কন্যারা পাবে। এক্ষেত্রে পুত্র যে পরিমান সম্পত্তি পাবে, কন্যা তার অর্ধেক পরিমাণ পাবে। তবে যদি কন্যা না থাকে, বাকী সম্পত্তি সম্পূর্ণ অংশ পুত্র পাবে।
কন্যাঃ মৃতের কন্যা ৩ (তিন) নিয়মে মৃতের সম্পদ পেয়ে থাকে, যথা-
১। যদি মৃত ব্যক্তির একজন কন্যা থাকে, তবে সে সম্পদের দুইভাগের একভাগ (১/২) পাবে।
২। যদি মৃত ব্যক্তির একাধিক কন্যা থাকে, তবে সব কন্যা একত্রে তিন ভাগের দুই ভাগ সম্পত্তি পাবে।
৩। যদি মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা উভয়েই থাকে, তবে পুত্র যে পরিমাণ সম্পত্তি পাবে, কন্যা তাঁর অর্ধেক পাবে।
দাদাঃ পিতার পিতা অর্থাৎ পিতামহ বা এর যত উপরে হোক না কেন, নিম্নলিখিত ভাবে মৃতের সম্পত্তি পাবে-
১। মৃতের পিতা জীবিত থাকলে দাদা সম্পত্তি পাবে না।
২। মৃতের পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকলে দাদা মোট সম্পত্তির (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
৩। মৃতের পুত্র সন্তান না থাকলে বা পুত্রের সন্তান (এভাবে নিচের দিকে) শুধু কন্যা হলে কন্যা সন্তানের সংগে দাদা মোট সম্পত্তির (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে এবং কন্যা বা পুত্রের কন্যাদের অংশ প্রদানের পর যা বাকী থাকবে, দাদা আসাবা হিসেবে তাও পাবে।
৪। মৃতের কোন সন্তান বা সন্তানের সন্তান (এভাবে নিচের দিকে) না থাকলে, অন্যান্যদের দেওয়ার পর দাদা আসাবা হিসেবে বাকী সমুদয় সম্পত্তি পাবে।
নানী ও দাদীঃ প্রকৃত নানী ও দাদী (যত উপরেই হোক)
১। নানী বা দাদীগণ মৃতের সম্পত্তির (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
২। মৃতের পিতা বা মাতা জীবিত থাকলে নানী বা দাদীগণ কোন সম্পত্তি পাবে না।
পুত্রের কন্যাঃ পুত্রের কন্যা বা পুত্রের পুত্রের কন্যার অবস্থা (এভাবে যত নিচেই হোক) নিম্নলিখিত ধরনের হবে-
১। মৃত ব্যক্তির কন্যা থাকলে, পুত্রের কন্যা কোন সম্পত্তি পাবে না।
২। মৃত ব্যক্তির একাধিক কন্যা জীবিত থাকলে, পুত্রের কন্যাগণ কোন সম্পত্তি পাবে না।
৩। মৃত ব্যক্তির একটি মাত্র কন্যা থাকলে মৃত পুত্রের কন্যাগণ (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
৪।পুত্রের কন্যা একজন হলে সম্পত্তির দুই ভাগের একভাগ পাবে।
৫। পুত্রের কন্যার সংখ্যা একাধিক হলে সকলে মিলে সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে।
৬। মৃত ব্যক্তির পুত্রের পুত্র বা তার পুত্র (যত নিচে হোক) থাকলে, পুত্রের কন্যাগণ পুত্রের সাথে আসাবা হিসেবে সম্পত্তি প্রাপ্ত হবে এবং কন্যা, পুত্রের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে।
বৈপিত্রেয় ভাইঃ বৈপিত্রেয় ভাই তিন ভাবে মৃতের সম্পত্তি পাবে, যথা-
১। একজন হলে (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
২। দুই বা ততোধিক হলে (১/৩) তিন ভাগের এক ভাগ পাবে।
৩। মৃতের সন্তান বা পুত্রের সন্তান (এভাবে যত নিচে হোক), পিতা বা দাদা জীবিত থাকলে বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভাই বা বোন কোন সম্পত্তি পাবে না।
মুসলিম ফারায়েজ আইনের আরও কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
নিকটবর্তী ওয়ারিশের কারণে দূরবর্তী ওয়ারিশ সম্পত্তি পাবে না। যেমন-পিতা থাকলে, দাদা সম্পত্তি পাবে না।
মৃত্যুকালে যার দ্বারা সম্পর্কযুক্ত, তিনি বেঁচে থাকলে পরবর্তী সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি সম্পত্তি পাবে না। যেমন- ভাই বেঁচে থাকলে, ভাইয়ের পুত্র সম্পত্তি পাবে না।
মৃত ব্যক্তির পিতাকে ১/৬ অংশ, মাতাকে ১/৬ অংশ, স্ত্রীকে ১/৮ অংশ দেবার পর বাকী সম্পত্তি পুত্র-কন্যা পাবে।
মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র না থাকলে স্ত্রীকে ১/৮ অংশ, কন্যাকে ১/২ অংশ, মাতাকে ১/৬ অংশ দেওয়ার পর বাকী অংশ পিতা পাবে। পিতা না থাকলে সেই অংশ ভাই-বোনেরা পাবে।
স্বামী/স্ত্রী বেঁচে থাকলে স্বামী/স্ত্রীর অংশ দেওয়ার পর মাতা অবশিষ্ট সম্পত্তির (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
পুত্র বা পিতার বর্তমানে ভাই/বোন ওয়ারিশ হয় না ।
স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা বা ভাই-বোন না থাকলে দূরবর্তী আত্মীয়গণ সম্পত্তি পাবে।
মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হলে পিতা (২/৩) তিন ভাগের দুই ভাগ, মাতা (১/৩) তিন ভাগের এক ভাগ পাবে।
পিতা, মাতা ও সন্তান না থাকলে বোন (১/২) অর্ধেক পাবে। বোন একাধিক হলে (২/৩) তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে, ভাই ও বোন উভয়ই থাকলে ভাই বোনের দ্বিগুন পাবে।
নিঃসন্তান বোনের সম্পত্তি ভাই পাবে।
লিঙ্গ নির্ধারনে সমস্যা রয়েছে, এমন সন্তানকে মেয়ে হিসেবে গণ্য করে সম্পদ বন্টন করতে হবে।
গর্ভস্থ সন্তানকে জীবিত হিসেবে গণ্য করে উত্তরাধিকার নির্ধারিত হবে। গর্ভস্থ সন্তানকে পুত্র গণ্য করে অথবা তার জন্মের পর সম্পদ বন্টন করতে হবে।
মৃত ব্যক্তির দেনা থাকলে, প্রাপ্য সম্পত্তির আনুপাতিক হারে ওয়ারিশদেরকে দেনা পরিশোধ করতে হবে।
মৃতের পিতা, পুত্র বা পৌত্র (পুত্রের পুত্র) থাকলে বোন সম্পত্তি পাবে না।
যার সম্পত্তি বন্টন হচ্ছে, তার মৃত্যুর পূর্বে তার কোন পুত্র বা কন্যা মারা গেলে, মৃত পুত্র বা কন্যার কোন সন্তান বর্তমান থাকলে, সে সন্তান ঐ পরিমাণ সম্পত্তি পাবে, যা তার পিতা বা মাতা জীবিত থাকলে পেত।
সহোদর ভাই, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের আগে ওয়ারিশ হবে।
কন্যা পিতার সম্পত্তির ন্যায় মায়ের সম্পত্তিতে অংশ পাবে।
মৃত ব্যক্তির পুত্র, কন্যা, পৌত্র (পুত্রের পুত্র) অথবা দাদা বর্তমান থাকলে বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই-বোন কোন সম্পত্তি পাবে না।
কোন উত্তরাধিকারী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে, যদি সে-
(ক) যার সম্পত্তি তাকে হত্যা করে
(খ) ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে।
পিতা ও মাতা না থাকলে, নানী (মাতার মাতা) ও দাদী (পিতার মাতা) থাকলে, উভয়ে একত্রে (১/৬) ছয় ভাগের এক ভাগ পাবে।
আসাবা বা অবশিষ্টাংশ প্রাপকঃ
মুসলিম আইন অনুযায়ী অংশীদারগনের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের পর যে সকল ব্যক্তি ওয়ারিশ হিসেবে অবশিষ্টাংশ সম্পত্তি পান, তাদেরকে আসাবা বা অবশিষ্টাংশ প্রাপক বলে।
মোট ৭ শ্রেণীর ব্যক্তি আসাবা হিসেবে অবশিষ্টাংশ সম্পত্তি পেয়ে থাকেন। নিম্নে এদের তালিকা দেয়া হল-
১। পুত্র, পুত্রের পুত্র… এভাবে নিচের দিকে
২। পিতা
৩। দাদা, দাদার দাদা… এভাবে ঊর্ধে
৪। সহদর ভাই বা তার পুত্র… এভাবে নিচের দিকে
৫। বৈমাত্রেয় ভাই বা তার পুত্র… এভাবে নিচের দিকে
৬। আপন চাচা বা তার পুত্র… এভাবে নিচের দিকে
৭। বৈমাত্রেয় চাচা বা তার পুত্র… এভাবে নিচের দিকে।
উত্তরাধিকারীর সম্পত্তির অংশের আউল বা বৃদ্ধি নীতিঃ
কোন সম্পত্তির নির্দিষ্ট ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশের যোগফল যদি মোট সম্পত্তির অধিক হয়, তবে প্রত্যেকের অংশ হারা-হারি ভাবে হ্রাস করে সম্পুর্ন সম্পত্তি বন্টন করতে হয়। এভাবে সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়াকে আউল বা বৃদ্ধি বলে।
উত্তরাধিকারীর সম্পত্তির অংশের রদ বা হ্রাস নীতিঃ
কোন সম্পত্তিতে যদি মৃত ব্যক্তির আসাবা ওয়ারিশ না থাকে এবং নির্দিষ্ট ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশের যোগফল যদি মোট সম্পত্তি হতে কম হয়, তবে প্রত্যেকের অংশ হারা-হারি ভাবে বৃদ্ধি করে সম্পুর্ন সম্পত্তি বন্টন করা হয়। এভাবে সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়াকে রদ বা হ্রাস বলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন